এ অধ্যায়ের শেষে আমরা ধারণা নিতে পারব ■ সংঘদান ও অষ্টপরিষ্কার দান কী; ■ সংঘদান ও অষ্টপরিষ্কার দান কেন করা হয়; ■ সংঘদানের নিয়মাবলি; ■ সংঘদানের সুফল; ■ দানানুষ্ঠানের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব। |
একদিন সুজন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। সেই সময় বাল্যবন্ধু বিদেশ ফেরত মহিউদ্দিন তার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। দীর্ঘদিন পরে পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ হয়। কুশল বিনিময় এবং আপ্যায়নের পর সুজন মহিউদ্দিনকে বললেন, দুই বছর পূর্বে আমার বাবা মারা গেছেন। আগামী মার্চ মাসের ১৫ তারিখ বাবার উদ্দেশ্যে অষ্টপরিষ্কারসহ সংঘদান করব। তা নিয়ে আমি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। মহিউদ্দিন অষ্টপরিষ্কারসহ সংঘদান কী জানতে চাইলেন। তিনি এ সম্পর্কে জানার জন্য খুবই আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সুজন তাকে বললেন, বৌদ্ধরা নানা রকম ধর্মীয় দান অনুষ্ঠান পালন করেন। এর মধ্যে সংঘদান অন্যতম। সংঘদান করার সময় অনেকে অষ্টপরিষ্কার দানও করেন। বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বৌদ্ধরা দান করে থাকেন। একেক দানের ফল একেক রকম। এরপর তিনি মহিউদ্দিনকে অষ্টপরিষ্কার ও সংঘদান কী, কেন করা হয়, এ দানের নিয়ম, সুফল এবং গুরুত্ব প্রভৃতি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। প্রথমে তিনি সংঘদান ও অষ্টপরিষ্কার দান কী এবং কেন করা হয় তা বর্ণনা করেন।
সংঘদান ও অষ্টপরিষ্কার দান কী এবং কেন করা হয়
‘সংঘ’ শব্দের বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। যেমন দল, সমিতি, সভা, পরিষদ, ইত্যাদি। ভিক্ষুসংঘ বলতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দল, সভা, সমাগম, পরিষদ ইত্যাদি বোঝায়। বৌদ্ধধর্ম মতে, পাঁচ বা তার বেশি ভিক্ষুর দল, পরিষদ বা সমাগমকে বলা হয় সংঘ। সংঘদান অনুষ্ঠানে ভিক্ষুসংঘকে আমন্ত্রণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধাচিত্তে প্রয়োজনীয় বস্তু দান করা হয়। তাই এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় সংঘদান । ত্রিপিটকে উল্লেখ আছে যে, একজন ভিক্ষুকে দান দেওয়ার চেয়ে সংঘকে দান দেওয়া খুবই ফলদায়ক। যে কোনো সময় এই সংঘদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। ভিক্ষু-ভিক্ষুণী, উপাসক-উপাসিকা, দায়ক-দায়িকা যে কেউ একক বা সমবেতভাবে বিহারে বা ঘরে সংঘদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন। সাধারণত উপাসক-উপাসিকা, দায়ক-দায়িকাবৃন্দ নিজ গৃহে সংঘদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
বৌদ্ধরা কোনো শুভ কাজ উপলক্ষ্যে সংঘদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বিবাহ, নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু, বিদেশ ভ্রমণ, তীর্থযাত্রা, নবজাতকের জন্ম, প্রব্রজ্যা গ্রহণ প্রভৃতি শুভ কর্মের আগে সংঘদান করা যায়।
তবে পরিবারের কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার সদগতি ও মঙ্গল কামনায় অবশ্যই সংঘদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়। এছাড়া, পুণ্য সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যেও সংঘদান করা যায়। সংঘদান অনুষ্ঠানে ভিক্ষুসংঘের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদেরও আমন্ত্রণ করে উত্তম খাদ্যদ্রব্যে আপ্যায়ন করা হয়।
সংঘদান অনুষ্ঠানে ভিক্ষুদের ব্যবহার্য এবং আহারের উপযোগী যে কোনো দ্রব্য দান করা যায়। যেমন, খাদ্য দ্রব্য, চীবর বা পরিধানের বস্ত্র, ঔষধ, লাঠি, ছাতা, সুই-সুতা, বই, খাতা, কলম-পেন্সিল, আসবাবপত্র, তোষক ইত্যাদি। কিন্তু অষ্টপরিষ্কার দানে আট প্রকার দ্রব্য দান করা অত্যাবশ্যক। ‘অষ্টপরিষ্কার' শব্দের অষ্ট অর্থ হলো আট, আর পরিষ্কার-এর অর্থ হলো উপকরণ। ভিক্ষুদের প্রয়োজনীয় নিমিত্ত আটটি নির্দিষ্ট উপকরণ বা বস্তু যে দান অনুষ্ঠানে ভিক্ষুসংঘকে দান করা হয় তাকে অষ্টপরিষ্কার দান বলে। অষ্টপরিষ্কার দানের আটটি দানীয় সামগ্রী হলো: সংঘাটি, উত্তরাসংঘ, অন্তর্বাস, পিণ্ডপাত্র, ক্ষুর, সূচ-সুতা, কটিবন্ধনী ও জলছাকুনি।
সংঘদান এককভাবে আয়োজন করা যায়। অষ্টপরিষ্কার দান সাধারণত সংঘদানের সঙ্গে আয়োজন করা হয়। অষ্টপরিষ্কার দানের অনেক সুফল রয়েছে। অষ্টপরিষ্কারসহ সংঘদান করলে আরো বেশী পুণ্য অর্জিত হয়। তাই বর্তমানে অষ্টপরিষ্কারসহ সংঘদান আয়োজনের প্রচলন বেশি লক্ষ করা যায়।
অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৬
কোন্ কোন্ শুভ কাজের আগে সংঘদান করা যায় তার একটি তালিকা তৈরি করো।
শুভ কাজের তালিকা
অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৭
সংঘদান ও অষ্টপরিষ্কার দানের দানীয় সামগ্রীর একটি তালিকা তৈরি করো (দলীয় কাজ)
সংঘদানের দানীয় সামগ্রীর তালিকা | অষ্টপরিষ্কার দানের দানীয় সামগ্রীর তালিকা |
১ | ১ |
২ | ২ |
৩ | ৩ |
৪ | ৪ |
৫ | ৫ |
৬ | ৬ |
৭ | ৭ |
৮ | ৮ |
সংঘদান ও অষ্টপরিষ্কার দান বর্ণনা করার পর সুজন মহিউদ্দিনকে সংঘদানের নিয়মাবলি বর্ণনা করেন।
সংঘদানের নিয়মাবলি
সংঘদান অনুষ্ঠানের আগে ভিক্ষুসংঘকে ফাং বা নিমন্ত্রণ করতে হয়। সংঘদানে ভিক্ষুর সংখ্যা যত হয় তত বেশী ভালো। সংঘদানে বিভিন্ন বিহারের ভিক্ষুকে আমন্ত্রণ করা যেতে পারে। সাধ্যমতো আত্মীয়-স্বজন, পাড়া- প্রতিবেশীদেরও নিমন্ত্রণ করা হয়। অনুষ্ঠানের দিন বাড়ির অঙ্গিনায় সুন্দরভাবে প্যান্ডেল তৈরি করা হয়। ভিক্ষু ও নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য সাজানো হয় পৃথক বসার আসন। ভিক্ষুদের আসনের সামনে দানীয় সামগ্রী সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। ভিক্ষুসংঘ আসন গ্রহণ করার সময় উপস্থিত সবাই সাধুবাদ দিয়ে স্বাগত জানান। ভিক্ষুসংঘ, দায়ক-দায়িকা বা অতিথিগণ আসন গ্রহণের পর শুরু হয় সংঘদানের কাজ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য ভিক্ষুসংঘের মধ্য হতে বয়োজ্যেষ্ঠ (বর্ষাবাস গণনায়) একজন ভিক্ষুকে সভাপতি নির্বাচন করা হয়। সভাপতির নির্দেশনা অনুসারে চলে দান অনুষ্ঠানের কাজ। উপস্থিত দায়ক-দায়িকার পক্ষ হতে একজনকে প্রথমে ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল প্রার্থনা করতে হয়। তারপর সভাপতি বা তাঁর নিদের্শে অভিজ্ঞ একজন ভিক্ষু পুনরায় ত্রিশরণসহ সংঘদান গাথা তিনবার আবৃত্তি করেন। গাথাটি এ রকম-
ইমং ভিন্খং সপরিক্খারাং ভিক্ষু সংঘস্ম দানং দেম পূজেম দুতিয়ম্পি ইমং ভিন্খং সপরিস্থারাং ভিক্ষু সংঘস দানং দেম পূজেম ততিয়ম্পি ইমং ভিত্থং সপরিন্থারাং ভিক্ষু সংঘস্স দানং দেম পূজেম। |
গাথার বাংলা অনুবাদ : আমরা এই প্রয়োজনীয় উপকরণ ভিক্ষু সংঘকে দান দিয়ে পূজা করছি। উপস্থিত সকলে গাথাটি সমস্বরে তিনবার আবৃত্তি করেন।
অষ্টপরিষ্কারসহ সংঘদান করা হলে অষ্টপরিষ্কার দানের উৎসর্গ গাথা আবৃত্তি করে সেই দানীয় সামগ্রী দান করতে হয়।
ভিক্ষুর সঙ্গে অষ্টপরিষ্কার দানের উৎসর্গ গাথা তিনবার আবৃত্তি করতে হয়। গাথাটি নিম্নরূপ :
ইমং ভিন্খং অটঠপরিহারাং ভিক্ষুসংঘসস্ দেম পূজেম দুতিযম্পি ইমং ভিন্খং অটঠপরিক্খারাং ভিসংঘসস্ দেম পূজেম ততিযম্পি ইমং ভিন্খং অটঠপরিক্খারাং ভিন্ধুসংঘসস্ দেম পূজেম। |
গাথার বঙ্গানুবাদ : আমরা এই প্রয়োজনীয় অষ্টপরিষ্কার (আট প্রকার উপকরণ) ভিক্ষুসংঘকে দান দিয়ে পূজা করছি।
দ্বিতীয় বার…………………..
তৃতীয় বার………………………………………..
এরপর, ভিক্ষুসংঘ সমস্বরে বিভিন্ন সূত্র পাঠ করেন। বিশেষত, করণীয় মৈত্রী সূত্র, মঙ্গলসূত্র, রতনসূত্র, অঙ্গুলীমাল সূত্র, আটানাটীয় সূত্র, বোঙ্গ সূত্র প্রভৃতি । সূত্র পাঠ শেষ হলে উপস্থিত দায়ক-দায়িকা বা অতিথি সাধুবাদ প্রদান করেন।
তারপর একজন গৃহী পুন্যানুমোদন গাথা অবৃত্তি করেন। তাঁকে অনুসরণ করে উপস্থিত দায়ক-দায়িকারা গাথাটি তিনবার আবৃত্তি করেন। পুন্যানুমোদন গাথা আবৃত্তিকালে দাতার পরিবারের একজন জল ঢেলে পুণ্যরাশি মৃত জ্ঞাতিসহ সকল প্রাণী ও দেবতাদের উদ্দেশ্যে দান করেন। গাথাটি এ রকম-
১ | ইদং মে (বো) ঞাতীনং হোতু, সুখিতা হোন্তু ঞাতয়ো (তিনবার) |
২ | উন্নমে উদকং বট্টং যথা নিম্নং পবত্ততি, এবমেব ইতো দিন্নং পেতানং উপকল্পতি (তিনবার) |
৩ | যথা বারিবহা পুরা পরিপুরেন্তি সাগরং, এবমেব ইতো দিন্নং পেতানং উপকল্পতি (তিনবার) |
৪ | এত্তাবতা চ অমহেহি সম্ভতং পুঞসম্পদং, সব্বে দেবা অনুমোদন্তু সব্ব সম্পত্তি সিদ্ধিয়া এত্তাবতা চ অমহেহি সম্ভতং পুঞসম্পদ সব্বে সত্তা অনুমোদন্তু সব্ব সম্পত্তি সিদ্ধিয়া এত্তাবতা চ অমহেহি সম্ভতং পুঞসম্পদং সব্বে ভূঙ্গ অনুমোদন্তু সব্ব সম্পত্তি সিদ্ধিয়া |
৫ | আকাসষ্ঠা চ ভুম্মষ্ঠা দেবনাগা মহিদ্ধিকা, পুং তং অনুমোদিত্বা চিরং রন্থন্তু সাসনং। আকাসষ্ঠা চ ভুম্মষ্ঠা দেবনাগা মহিদ্ধিকা, পুং তং অনুমোদিত্বা চিরং রন্থন্তু দেসনং । আকাসষ্ঠা চ ভুম্মষ্ঠা দেবনাগা মহিদ্ধিকা, পুঞ্জং তং অনুমোদিত্বা চিরং রন্থন্তু মং পরং। |
৬ | ইমেনা পুঞকম্মেন মা মে বালা সমাগমো, সতং সমাগমো হোতু যাব নিব্বানপত্তিয়া। ইদং মে পুঞ্জং নিব্বান পচ্চয়ো হোতু’তি, আসবকথয়াবহং হোতু। |
বাংলা অনুবাদ
১. এই দানের দ্বারা সঞ্চিত পুণ্য আমাদের জ্ঞাতিগণের হোক। এর দ্বারা আমার জ্ঞাতিগণ সুখী হোক। (তিনবার)
২. জল যেমন উচ্চ স্থান হতে গড়িয়ে নিচের দিকে যায়, সেরূপ মনুষ্যলোক হতে জ্ঞাতিগণের প্রদত্ত পুণ্যরাশি প্রেতগণের উপকার করে।
৩. জলপ্রবহমান নদীগুলো যেমন ক্রমে সাগর পরিপূর্ণ করে, তেমনি এখান হতে জ্ঞাতির প্রদত্ত দানময় পুণ্যরাশি পরলোকগত প্রেতদের উপকার করে থাকে।
৪. এই যাবৎ আমরা যে পুণ্যসম্পদ সঞ্চয় করেছি, তা সমস্ত সম্পত্তি সিদ্ধির জন্য দেবতা, সত্তা ও প্রাণিগণ অনুমোদন বা সাদরে গ্রহণ করুন। (তিনবার)
৫. আকাশবাসী, ভূমিবাসী দেব এবং নাগগণ এই পুণ্য সম্পদ অনুমোদন করে চিরকাল লোকশাসন, বুদ্ধশাসন, প্রজ্ঞাপ্তধর্ম, দেশনাধর্ম, আমাকে এবং অপর প্রাণীকে সকল প্রকার উপদ্রব হতে রক্ষা করুন।
৬. আমি নির্বাণ লাভ না করা পর্যন্ত আমার সঙ্গে যেন অসৎ ব্যক্তির সংশ্রব না ঘটে, এই পুণ্য আমার নির্বাণ লাভের হেতু হোক।
যথাযথ নিয়মে দান শেষ হওয়ার পর ভিক্ষুসংঘকে উত্তম খাবারে আপ্যায়ন করা হয়। অনুষ্ঠান চলাকালে যাতে কোথাও কোনো ত্রুটি না হয় সেজন্য বয়োজ্যেষ্ঠরা পুরো কার্যক্রম তদারকি করেন। ভিক্ষুসংঘের ভোজনের পর পরিবারের পক্ষ থেকে দানীয় সামগ্রী, দক্ষিণা এবং পাথেয় শ্রদ্ধাচিত্তে বন্দনাসহ ভিক্ষুসংঘকে প্রদান করা হয়। ভিক্ষুসংঘ আশীর্বাণী দিয়ে তা গ্রহণ করেন এবং কিছু উপদেশ, পরামর্শ ও উপস্থিত সকলকে আশীর্বাদ দিয়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। ভিক্ষুসংঘ অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগকালে উপস্থিত সকলে সমবেতভাবে ভিক্ষুসংঘকে বন্দনা নিবেদন করে শ্রদ্ধা সহকারে বিদায় জানান। ভিক্ষুসংঘ চলে যাওয়ার পর নিমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ আহার গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ঐদিন অনুষ্ঠানটি স্বজন মেলায় পরিণত হয়। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়- স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের মিলন ঘটে। প্রত্যেকে পারস্পরিক কুশল বিনিময় করেন।
অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৮
সংঘদানের প্রক্রিয়াটি সবাই মিলে ভূমিকাভিনয় করে উপস্থাপন করো। (ঐচ্ছিক)
অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৯
তোমার দেখা একটি অষ্টপরিষ্কারসহ সংঘদান অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন লেখো (একক কাজ)। অনুগ্রহ করে ক্লাস শিক্ষকের কাছে জমা দাও।
সুজনের আলোচনা শুনে মহিউদ্দিন পুলকিত হলেন এবং সংঘদানের সুফল সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন সুজন তাকে একটি দান কাহিনিসহ সংঘদানের সুফল বর্ণনা করেন।
সংঘদানের সুফল
বুদ্ধ সংঘদানের ফল সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন,
পঠবী সাগরো মেরু খয়ং যন্তি যুগে যুগে কল্পানি সতসহস্পানি সংঘে দিন্নং ন নস্পতি। |
অর্থাৎ “যুগে যুগে পৃথিবী সাগর, মেরু প্রভৃতি ক্ষয় হয়ে যায়, কিন্তু শত সহস্রকল্পেও সংঘদানের দ্বারা অর্জিত ফল বা পুণ্য রাশি শেষ হয় না।”
অষ্টপরিষ্কারসহ সংঘদানের সুফল আরো তাৎপর্যপূর্ণ। অষ্টপরিষ্কার দানের ফলে দাতা জন্ম-জন্মান্তরে ধনশালী, ভোগশালী ও রূপশ্রীমণ্ডিত হয়। যশ-খ্যাতির অধিকারী হয়। জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হয়। নানা শাস্ত্র ও শিল্পকলায় দক্ষ হয়। দেবগণ দ্বারা আপদে-বিপদে রক্ষিত ও সম্মানিত হয়। রোগহীন, নির্ভীক ও বিশুদ্ধ দেহপ্রাপ্ত হয়।
এরপর, সুজন মহিউদ্দিনকে সংক্ষেপে একটি দান কাহিনিও বর্ণনা করেন।
পূর্ণা নামে এক দাসী ছিলেন। তিনি দরিদ্র হলেও দান করতে খুবই পছন্দ করতেন। একদিন গৃহকর্ম করার পর তিনি ক্লান্ত শরীরে পুকুর ঘাটে বসে আহার গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সে সময় একজন বৌদ্ধভিক্ষু ভিক্ষান্ন সংগ্রহের জন্য সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পূর্ণার তাঁকে দেখে খাবারগুলো দান করার ইচ্ছা হলো। কিন্তু রুটিগুলো ছিল আধপোড়া। ফলে তিনি ইতস্তঃত বোধ করছিলেন। দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি ভিক্ষুর নিকট গিয়ে বন্দনা নিবেদনপূর্বক জিজ্ঞাসা করলেন, “ভন্তে ! আমার কাছে দুটি আধপোড়া রুটি আছে। আমি আপনাকে তা দান করতে ইচ্ছুক।'
আপনি কি আমার এ দান গ্রহণ করবেন? তখন ভিক্ষু বললেন, বিত্তের চেয়ে চিত্ত সম্পদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভিক্ষুর কথা শুনে পূর্ণা আশ্বস্ত হলেন এবং শ্রদ্ধাচিত্তে ভিক্ষুকে রুটিগুলো দান করলেন। ভিক্ষু আনন্দ চিত্তে সেই রুটি গ্রহণ করলেন। এই দানের ফলে পূর্ণা স্রোতাপত্তি ফল লাভ করেন। সংঘদান ও অষ্টপরিষ্কার দানের সুফল জেনে মহিউদ্দিনের দান সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে যায়। এরপর, তিনি দানের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব বর্ণনা করার জন্য সুজনকে অনুরোধ করেন। সুজন তাকে দানানুষ্ঠানের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করেন।
দানানুষ্ঠানের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব
বৌদ্ধদের প্রধান লক্ষ্য নির্বাণ লাভ করা। আর দশ পারমী হলো নির্বাণ লাভের সিঁড়ি। দশ পারমী পূর্ণ না করলে নির্বাণ লাভের পথে অগ্রসর হওয়া যায় না। দশ পারমীর মধ্যে দান পারমীর স্থান সবার আগে। উত্তম এবং মঙ্গল কাজসমূহের মধ্যেও দান অন্যতম। দান একটি মহৎ গুণ। এই মহৎ গুণটি বিকাশে দানানুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দানানুষ্ঠান মানুষকে নীতিবান ও শীলবান হতে উদ্বুদ্ধ করে। দানানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলে দানের অভ্যাস গড়ে ওঠে। দয়া, উদারতা এবং পরোপকারী মনোভাব সৃষ্টি হয়। অপরদিকে, কৃপণতা, লোভ-দ্বেষ-মোহ, অহংকার প্রভৃতি দূর হয়। গৌতম বুদ্ধ জন্ম-জন্মান্তরে অসংখ্য দান করে দান পারমীসহ দশ পারমী পূর্ণ করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন।
দানানুষ্ঠানে ভিক্ষুসংঘ, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী অংশগ্রহণ করে। ফলে দায়ক-দায়িকা এবং ভিক্ষুদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভিক্ষুগণ ধর্মোপদেশ দান করে দায়ক-দায়িকাদের পাপকর্ম হতে বিরত এবং পুণ্যকর্ম সম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করেন। অপরদিকে, দায়ক-দায়িকা ভিক্ষুদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য দান করে ধর্মচর্চা করতে সাহায্য করে। এছাড়া দানানুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যেও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়। ফলে সমাজে শান্তি বিরাজ করে। দানের মাধ্যমে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নানা রকম সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা যায়। বর্তমানে মানুষ ধন-সম্পদের পাশাপাশি শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও রক্ত দান করছে। ফলে অনেক মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে, দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাচ্ছে। এতে বোঝা যায়, দানানুষ্ঠানের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব অনেক।
আলোচনাশেষে সুজন মার্চ মাসের ১৫ তারিখ অষ্টপরিষ্কারসহ সংঘদান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য মহিউদ্দিনসহ অন্যান্য ধর্ম অনুসারী আরও কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে নিমন্ত্রণ করেন, যেমন - মাইকেল ধনঞ্জয়, দুর্গা ও ফাতেমা। তাঁরা যথাসময়ে আনন্দ সহকারে অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। তাঁরা স্বচক্ষে অষ্টপরিষ্কারসহ সংঘদান অনুষ্ঠান দেখে খুব খুশী হন। তাঁদের মধ্যেও দানচেতনা জাগ্রত হয়। অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়। সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য দৃঢ় হয়। তাঁরা দান ও সেবামূলক কর্ম করার জন্য অনুপ্রাণিত হন।
অংশগ্রহণমূলক কাজ : ১০ দানানুষ্ঠানে অংশগ্রহণের উপকারিতা সম্পর্কে সাতটি বাক্য লেখো। |
অংশগ্রহণমূলক কাজ : ১১
স্ব-অভিজ্ঞতামূলক প্রতিবেদন লেখা অভিজ্ঞতাটি সম্পর্কে তোমার লিখিত মতামত দাও।
কার্যক্রমের কী কী ভালো লেগেছে (ভালো দিক) - - - কার্যক্রম করতে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছ, (প্রতিবন্ধকতাসমূহ) - - - সমস্যা নিরসনে কী কী ব্যবস্থা নেয়া যায়? - - - ভবিষ্যতে আর কী কী উন্নয়ন করা যায় (পরামর্শ) - - - |
ফিরে দেখা: নিচের তালিকার সকল কাজ কি আমরা শেষ করেছি? হ্যাঁ হলে হ্যাঁ ঘরে এবং না হলে না ঘরে (√) চিহ্ন দাও:
অংশগ্রহণমূলক কাজ নং | সম্পূর্ণ করেছি | |
হ্যাঁ | না | |
৬ | ||
৭ | ||
৮ | ||
৯ | ||
১০ | ||
১১ |
এসো করি দান, হই মহীয়ান।।
Read more